শুক্রবার, ১৩ মে, ২০১১

কবিতার গদ্য : নির্ঝর নৈঃশব্দ্য


যে আমি কবিতার সাথে থাকিচোখের অপরপারে রাখি দুটি চোখপাখি

০১.
কবিতা মূলতই স্বতঃস্ফূর্ত এবং কবির অস্তিত্বের যন্ত্রণাকে প্রকাশ করে। কবিতা মন্ময়। কবির উপলব্ধি এবং একান্ত সুন্দর অথবা আত্মরতিকে প্রকাশ করে।
প্রতিক্রিয়া কিংবা দায় থেকে আর যা-ই সৃষ্টি হোক শিল্প হয় না। চাই বা না চাই আমি সমাজবদ্ধ, এটা সত্যি। তাই আমার ভিতর আমাকে ঘিরে থাকা প্রতিবেশ ক্রিয়া করবেই। এবং তা আমার লেখার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই আসবে যদি আসে। যদি আমি আরোপ করি তবে তা মঞ্চের জন্যে তৈরি বক্তব্য ছাড়া আর কিছু হবে না।

কবিতা মহত্তম শিল্প। আর শিল্প কারো কাছে দায়বদ্ধ নয়। সরাসরি দায় অথবা প্রতিক্রিয়া থেকে কবিতা হয় না। তাই কবিতা সরাসরি কোনো ডাক বহন করে না। যারা কবিতাকে কালের ডাকপিয়ন বানিয়েছেন, তারা এবং তাদের সৃষ্টি কিছু হয়েছে কিনা তা বিবেচ্য।

যে আমি কবিতার সাথে থাকি- চোখের অপরপারে রাখি দুটি চোখপাখি। আমার এই রকম মনে হয়, আমি জানি না নিজস¡ কোনো স¡র রপ্ত করতে পেরেছি কিনা এখনো। আমি কবিতা লিখতে চাই, এটা সত্যি। সবকিছুর উপর কবিতা সত্য। একটা কবিতা লেখার জন্যে আমি অনেক কিছুই ছাড়তে পারি। কারণ সত্যি সত্যিই কবিতা লিখতে চাই, একটা সত্যিকারের কবিতা। আমার একান্ত কবিতা। আমার ধ্যান পুরোপুরি শিল্পন্দনে, যার ভিত্তি রচনা করেছে কবিতা-ই। আমি শেষপর্যন্ত একটা কবিতা হলেও লিখতে চাই। আমি সবসময় চেয়েছি নিজের একটা ধরন দাঁড় করাতে, অন্যদের থেকে নিজের লেখাকে আলাদা করতে। হয়তো এখনো পারি নি। তবে একদিন হবে, আমি জানি। কেনো না আমি শেষপর্যন্ত একটা হলেও কবিতা লিখবো ঠিক করেছি। কখনো যদি একটা কবিতা লিখে ফেলতে পারি! কখনো যদি একটা কবিতা লিখে ফেলতে পারি! কখনো যদি একটা কবিতা লিখে ফেলতে পারি! কেবল সেই জন্যেই বেঁচে থাকা।

০২.
আমি যখন পড়ি- কখনোই মনে করি না যে কবি কী বলতে চেয়েছেন তা আমি জানি। সেটা কবিও জানেন কিনা সংশয়। তবে সেটা অবশ্যই সাহিত্যের অধ্যাপক জানেন। কেউ সত্যি সত্যি কবির মনের কথা জানতে চাইলে সাহিত্যের অধ্যাপকের কাছে যান।
আমি সাধারণ পাঠক। আমি কবিতাকে নিজের মতো পাঠ করবো। এবং নিজস্ব ব্যাখ্যান প্রকাশ করবো।

কবিতা কী? কিংবা পদ্য আর কবিতার মধ্যে পার্থক্য কী? এটা সাধারণ প্রশ্ন। এবং আমি কী মনে করি?

আমি মনে করি পদ্য হলো পদ্যকারের সৃষ্টি করে দেয়া একটি জগত। যেখানে পাঠক বিচরণ করবে। বিচরণ করা আর প্রস্তুতকৃত রস আস্বাদন করা ছাড়া পাঠকের আর কোনো কাজ নেই। যেমন, আমাদের ছোটোনদী চলে বাঁকে বাঁকে... শোনার সাথে সাথেই আমরা নদীর বাঁকে চলে যাই এবং পদ্যকারকৃত দৃশ্যে ঘোরাঘুরি করি। নিজে কিছু বানাই না। অন্যেরটা খাই, অন্যেরটা পরি।

কবিতা হলো একটা অন্তহীন অভাবনীয় জগতের দরজা। যেটা কবি তৈরি করেন। তারপর তিনি মৃত। পাঠক সেই দরজা দিয়ে ঢুকে নিজের মতো করে জগতটাকে তৈরি করেন এবং বিরচরণ করেন।

মনে করেন কবিতা একটি, আর দরজাও একটি। কিন্তু পাঠক অনেক। তাহলে কি পাঠক একই জগত তৈরি করবেন? না, পাঠকের অভিজ্ঞতা আর চিন্তার ভিন্নতার কারণেই পাঠক একই দরজা দিয়ে ঢুকে ভিন্ন ভিন্ন জগত তৈরি করবেন। পাঠক বেরিয়ে এসে পুনর্বার প্রবেশে তার জগত পাল্টেও যেতে পারে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পাঠক জানবেন না, কবি কী বলতে চেয়েছেন। সোনারতরী কবিতা সম্পর্কে রবিঠাকুর কে জিজ্ঞেস করা হলে বলেছিলেন তিনি এইখানে বর্ষার চিত্র ছাড়া কিছুই বিস্তার করেন নি। অথচ সাহিত্যের অধ্যাপকরা এই কবিতা নিয়ে ইহকাল আর পরকাল একাকার করেছেন।

আমি কী লিখেছি সেটা বড় কথা নয়। আপনি যা বুঝবেন তাই-ই সমস্ত। আর যদি কিছুই না বুঝেন, তবে এইটা কিছুই হয় নাই। আমি নিজেই এটাকে এগারো কিংবা তেরোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি। প্রথমে আমার আঁকা একটা পেইন্টিং এর বিবরণ লিখেছিলাম। ছবিটা বেশ কিছুদিন ছিলো আমার দেয়ালে। হঠা একদিন এক সুতীব্র ঘোরের ভিতর খুব নিষ্ঠুরভাবে ছবিটাকে নষ্ট করলাম, ফালি ফালি করে কাটলাম এন্টিকাটার দিয়ে। তারপর লেখাটা আমার কাছে অন্য অর্থ হয়ে গেলো।

মনে করেন আপনার প্রিয়তমনারীটি এসে আপনার ধবধবে বালিশে শুলো। তার দীঘল একটি চুল বালিশে ঝরে পড়লো, গোধূলি দিগন্তরঙ এবং আলোয় পাল্টে দিলো নকশা বর্ণ এবং ঘ্রাণ। এই মহানসৌন্দর্য বুকে ধরে বালিশটি ক্রমে অচেনা হলো...
বাকিটা আপনি ভাবেন।

মূলত নারী এবং রাত্রি বিভিন্ন নয়। রাত্রি যেমন সৃষ্টির আধার তেমন নারীও...
পরে মনে হয়েছে আমি উক্ত কবিতায় এক আশ্চর্যসুন্দর সঙ্গমের স্মৃতিই বর্ণনা করেছি। এইখানে অবসাদ আছে।
 ০৩.
অনেকেই কবিতাকে শব্দের খেলা মনে করেন। মনে করেন হাজার হাজার শব্দ, রূপ, অলঙ্কার, মতো মতো মতো ইত্যাদি। অনেকে আবার শব্দমোহে ডুবে থাকেন; শব্দের মায়া কাটাতে পারেন না। চমকপ্রদশব্দ (যথা: যোনি, শিশ্ন, স্তন, পোঁদ, গোদ, মূত্র, ভগাঙ্কুর, রজঃ, বীর্য, সঙ্গম, শীকার, মাস্টারবেট) সহযোগে অসার্থক শব্দবন্ধ তৈরি করে পুরো কবিতার ভারসাম্যকে নষ্ট করে আলোচিত এবং পরিচিত হতে পছন্দ করেন। দাদা, ইহাকেই স্টান্টবাজি বলে। অনেকেই মনে করেন বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি হেতু তার কবিতাও আবেগে টলটলে দিঘি জলাশয় বাদামক্ষেতবহুল প্রমূখ। অনেকেই আবার ঐতিহ্যের কথা বলে আটশোবছরের ভিনদেশি শব্দ এবং তারও আগের পৌরাণিক শব্দে ফিরে যেতে চান। অনেকেই দশপাতা ভাবালুতা করে বলেন ইহা কবিতা লিখেছি, দাদা; হাহাহাহাহাহা...

কবিতায় ইতিহাস-পুরাণ যাবতীয় কিছু থাকবে। কেবল ওই সময়কে অভ্যাসে ধরবো না আমি। দাদা, ইহা আমার মত।

আমি যদি জলের সাথে যোনি শব্দের তালমতো প্রয়োগ করতে না পারি তবে বাক্য শব্দদুটিকে বমি করে বিচ্ছিন্ন করে দেবে, সত্যি। যোনি, স্তন ইত্যকার শব্দাবলি জীবনানন্দও বাক্যে প্রয়োগ করেছেন। কিন্তু সেগুলি আলাদা করে চোখে লাগে না। বাক্যেরই অংশ হয়ে গেছে। কিন্তু আপনার যৌনাঙ্গদরজা, উরুরাস্তা প্রমুখ শব্দজোড় কেমন যেনো খচ করে চোখে বিঁধলো, কানে বাজলো না তেমন। তাই আরোপিত মনে হলো; স্বতঃস্ফূর্ত মনে হলো না। মনে হলো ভাবনা-চিন্তা করে বানিয়েছেন শব্দগুলি; অতঃপর প্রয়োগ করেছেন। আধুনিক কবিতার সূচনা করেছিলেন জীবনানন্দ, তাই তার কাছ থেকেই উল্লেখটা দিলাম, ‘আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর...

যোনিলগ্নজল বললে জল আর প্রধান থাকে না, যোনি প্রধান হয়ে উঠে। এই শব্দজোড় শুনে বা পড়ে আমাদের চোখে প্রথেমেই যে দৃশ্যকল্প তৈরি হয় তা কীসের? জলের, নাকি যোনির? সুতরাং আমরা যখন কোনো শব্দজোড় তৈরি করবো তখন দুটি শব্দের মধ্যে যদি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারি, তবে সে শব্দজোড় ব্যর্থ। যৌনাঙ্গদরজার  ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে শব্দের সাথে শব্দের, শব্দের সাথে বাক্যের ভারসাম্যের ব্যাপারটা; এটাই কবিতার মৌলিক ছন্দ।

শিশ্নিত কাঁটায় আটকে আছে ছায়াচুর দুপুরের রূপ
আমি নিরন্তর অন্ধ হয়ে গেলাম
একটি জংলিগুল্মের কথা মনে হলো কেবল
স্তনের শিরা তার ছুঁয়ে গেছে পূর্বের সকল জনপদ...
কবিতায় যোনি, শিশ্ন, ভগাঙ্কুর, স্তন, নিতম্ব, উরু এইসব শব্দ প্রয়োগের ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই।

আমি নিজেও করেছি বহুবার। কিন্তু প্রয়োগের আগে আমাদের যেটা দরকার, তা হলো অবশ্যই হাজারবার ভাবতে হবে। যাতে তাল রক্ষা করতে পারে; বাহুল্য না হয়, কিংবা ঝুলে না পড়ে।

কখনো পাতার ভাঁজে কাঁপন এঁকে আসঙ্গ হও যদি
মুনিয়ার ঠোঁটে আঙুল রেখে আমিও হতে পারি নদী
আমার একজন কবি ভগাঙ্কুরের নামকরণ করেছে একটা পাখির নামে। পাখিটি বাঙলাদেশের সবচে' ছোটোপাখি, নাম মুনিয়া। প্রকৃত অর্থে নামকরণটা আমিই করেছি। আমি ছাড়া আমার কেউ নেই।

শক্তিমান কবিরা কখনোই শব্দপ্রধান কবিতা লিখেন না, আমার কেবল এইরকমই মনে হয়েছে। কবিতা হবে সমস্ত বাহুল্যবর্জিত, ধনুকের ছিলার মতো টানটান। এবং পরিচ্ছন্ন।

০৪.
আমি অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহার করি না বললেই চলে। কেননা অপ্রচলিত শব্দ প্রয়োগের পক্ষে আমি নই। যদি কোনো বাক্যে অপ্রচলিত কোনো শব্দ অপরিহার্য হয়, তবে করি।

আমি সচেতন ভাবেই আমার বাক্যরচনায় সমস্ত চিহ্ন বর্জন করেছি। এবং আমি এমন কোনো বাক্য তৈরি করি না যে বাক্য বিরাম কিংবা যে কোনো চিহ্ন দাবী করে। আমার বাক্য যদি কোনো অর্থ প্রকাশ না করে, তবে তা চিহ্নের অভাবে নয়, আমার সক্ষমতার অভাবে।

কখনো সমস্ত বাক্যরচনার ভিতর কেবল একটি শব্দই কবিতাটিকে ধারণ এবং প্রকাশ করতে সক্ষম। বাকিটা ওই বিশেষ শব্দের অবগুণ্ঠন।

দৃশ্যগুলি যদি আপনি প্রলম্বিত এবং কল্পনা করতে না পারেন- সে আমারই ব্যর্থতা। এখানে পরের লাইনের সাথে সম্পর্ক তেমন অপরিহার্য নয়। যেহেতু একজনের (যে দৃষ্টির বাইরেও দেখতে পায়, কিংবা ধরেন, নিওরোটিক কেউ) মুখ থেকেই কথাগুলি বের হচ্ছে সেহেতু একটা সম্পর্ক আছে তো বটেই।

রাবণের সাথে সিঁথির একটা সম্পর্ক আছে। বলেন তো, কী? এখানে কথক এবং রাবণ একাকার।

শব্দজোড়ের ব্যাপারে নতুন-পুরাতন, প্রচলিত-অপ্রচলিত বিষয়টা আমার মাথায় থাকে না যখন লিখি, যে শব্দটা অন্য যে শব্দটাকে সহজে বাঁধতে পারে- বাঁধতে দিই। যা লিখি একবারেই লিখি, যে শব্দ স¡তঃস্ফূর্তভাবে আসে তাকে কাটি না, আমি মূলত বাক্যের আধুনিকতা নিয়ে ভাবি।

তবে শব্দের ক্ষেত্রে একটা বিষয় মানি প্রায় সবক্ষেত্রে, তা হলো গাছকে গাছ লিখি, তরু কিংবা মহীরুহ লিখি না, তেমনি আকাশকে গগন, মেঘকে অভ্র বা জলদ এইসব লিখি না। যা আমরা সচরাচর বলি সেই শব্দই লেখার চেষ্টা করি।


কবিতাই আমার ঈশ্বর। তাকে আমি ছুঁতে পারি, ধারণ করতে পারি। আমাকেও সে পারে। কবিতা আমার লৌকিক ঈশ¡র। আমি তার ধ্যানই করি।

প্রতিদিন লিখলে প্রেসরিলিজ হবে এইকথাটা পুরোপুরি ঠিক নয় এবং সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আবার চাইলেই প্রতিদিন লেখা যায় না। মাঝে মাঝে অনেকদিন লিখতে পারি না। তবে যখন লিখি সারাক্ষণ লিখতে পারি। এটা অবশ্যই স্বতঃস্ফূর্ত।

০৫.
আমরা অনেকেই এখনো ন্যারেটিভই লিখি কবিতায়। কবিতাকে যদি বৈশ্বিক ধরি তবে পশ্চিমা কবিরা ন্যারেটিভ ভেঙে দিয়েছে ষাটের দশকে। এবং প্রতিটি লাইনের পরে যে শূন্যস্থান তৈরি করেছে তা পাঠক পুরণ করার জন্যে। গ্লোরিয়া গার্ভিজ লিখলেন,


Immoderate begger
empty-handed hostess

barren mother

the light dims
insidious
as a gadfly

I'm not permitted to understand

প্রত্যেক কবিই তার সময়ের আধুনিক কবিতাই লিখেন। এইজন্যে আমরা কবিতার দশক বিচার করি। কারণ সময় চিন্তা প্রবণতা সবকিছু পাল্টায়, ধরন এবং প্রকরণও পাল্টায়। সময় এইখানে ফ্যাক্ট। দশক বিচার করি কারণ আমাদের পূর্বের কবিরা তাদের যৌবনের মতোই কবিতা লিখেন, তারা সময়কে ধরতে জানেন না।
একমাত্র ব্যতিক্রম শঙ্খ ঘোষ (মৃতদের মধ্যে বিনয় মজুমদার), যাকে কোনো দশকে ফেলা যাবে না। তিনি প্রতিনিয়ত নিজেকে নবায়ন করেন।

কবিতাকে আমি বৈশ্বিক মনে করি। যেহেতু আমাদের অবিমিশ্র সংস্কৃতির কোনো ইতিহাস নেই। কবিতা ধরবে সময় এবং সমসাময়িক প্রকরণ। যা প্রথাকে ছিন্ন করে।
নতুন প্রকরণ তৈরি করে। কবিতাকে ভৌগলিক সীমারেখায় নয়, ধরতে হবে বৈশি¡ক দৃষ্টিতে। আপনাকে আপনার সময়ের শ্রেষ্ঠ কবি হতে হবে। হতে পারেন বা না পারেন সেটা মুখ্য নয়। স্বপ্নটাই সমস্ত। স্বপ্ন মানুষকে গতি দেয়।

কবি যদি বুঝতে পারেনÑ তিনি আর লিখতে পারছেন নাÑ তাহলে তার লেখা ছেড়ে দেয়া উচিত কিংবা লিখে নষ্ট করা উচিত।

কবিতায় শুধু নয়আধুনিকতা-উত্তরাধুনিকা সবখানেই আছে। আধুনিকতা কোনো দৃষ্টিভঙ্গি নয়, এটি সময়। কিন্তু উত্তরাধুনিকতা একটি দৃষ্টিভঙ্গি।

প্রধান কবিকে তৈরি করা হয়, আর শক্তিমান কবি যন্ত্রণা আর সাধনার মধ্য দিয়ে নিজেকে তৈরি করেন। আমরা এমিলি ডিকিনসনের কথা বলতে পারি, এমিলি তিরিশবছর একটি ঘরে নিজেকে বন্দী করে রেখেছিলেন। বলতে পারি শার্ল বোদলেয়ারের কথা।

০৬.
কার্তিকের হিম জাতীয় ফ্রেইজগুলি নিয়ে একটু ভাববেন। জীবনানন্দ আমাদের রক্তের ভিতর। কিন্তু তাকে অতিক্রম করা যাবে না, এটা ভুল কথা। অতিক্রম করা মানে তার চেয়ে ভালো লেখা বা খারাপ লেখা এইজাতীয় কিছু নয়, এর মানে হলো তার মতো না লেখা। আর তার চেয়ে ভালো লেখার বা খারাপ লেখার বিষয়টা মাথার মধ্যে আনাটাই ভুল। যেহেতু তিনি তার সময়ের দেদীপ্যমান। আর আমরা আমাদের অন্ধকারকে আলোকিত করবো।
কারো সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করার মতো সীমা এখনো অতিক্রম করি নাই, দাদা। তবে একটা ছোট্ট পরামর্শ দিতে পারি, নার্সিসাস হয়েছেন তো মরেছেন। নিজের লেখা যতোবার পড়বেন ততোবার ফাঁক পাবেন। নিজের সদ্য লেখা কবিতাটি বিরতি দিয়ে অন্তত  তেরোবার অথবা তেইশবার পড়েন নিজেই বুঝতে পারবেন, কী সমস্যা। লেখাটা পুনর্বার লেখেন, আবারও লেখেন। দেখবেন পাল্টে গেছে এবং আরো সহজ সুন্দর হয়ে গেছে।

আমরা তাকে, তাহাকে অথবা তাদের বেশি বেশি পড়ি এবং পড়বো- তাদের মতো না লেখার জন্যে।

আমার গানের আবেগ, তাহার চরের কথা এইসব লেখা যাবে না বলি নাই তো! একই বিষয় একই শব্দ সবাই ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু আমি বলতে চেয়েছি মাঘের কুয়াশা, কার্তিকের হিম, শিশিরের শব্দের মতো, উটের গ্রীবা এইজাতীয় শব্দজোড়ের ব্যাপারে বিবেচনা করতে। কেননা এইসব সরাসরি জীবনানন্দীয়।

এই যে আপনি ঠিক করলেন, শর শেষের হিম। পড়তেই ভালো লাগছে। এখন কেউ ঢুকেই বলতে পারবে না, জীবনানন্দের প্রভাব। এতো কষ্ট করেছেন, শুরুতেই এমন কথা শুনলে দমে যাওয়ার কথা। আমার ক্ষেত্রে এমনই হতো। জীবনানন্দ আমার প্রথমপ্রেম। তাই একটু অন্যমনস্ক হলেই তিনি ঢুকে পড়েন। তবে বুঝতে পারলেই তাকে অন্যত্র তার গ্রন্থেই সযতনে তুলে রাখি।

এইবার আসি দুটি অতিচল শব্দজোড়ের কাছে। একটি মুঠোফোন, অন্যটি মেঘবালিকা। এইদুইটির বহুল ব্যবহার বিলবোর্ড থেকে শুরু করে আপনার গানে কবিতায় সেই কবে থেকে দেখছি! আপনি হঠা করে রৌদ্রের গন্ধ ছেড়ে মুঠোফোন এবং মেঘবালিকার চর্চক হয়ে গেলেন! কেনো দাদা?

জীবনানন্দ একদা লিখেছিলেন ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল, এর আগে ইয়েট্স এর কাছ থেকে নিয়ে লিখেছিলেন, ‘শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা আসে।তিনি যদি ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিলএর মতো বাক্য রচনা করতে না পারতেন তবে ইয়েট্স এর ভিতর তলিয়ে যেতেন। তিনি ক্ষমতাবান। তিনি ইয়েট্সকে অতিক্রম করতে পেরেছেন। আমার কথা হলো রৌদ্রের গন্ধ জীবনানন্দের বানানো। অন্যের জিনিশ আমরা কেনো নিবো যদি আমাদের নতুন করে বানানোর ক্ষমতা থাকে। ঠিক তেমনি মেঘবালিকা জয় গোস্বামীর আর মুঠোফোন নির্মলেন্দুগুণের। আপনার কবিতায় এইসব শব্দজোড় যখনি পড়ি আপনাকে অযোগ্য মনে হয়, মনে হয় নিজে কিছু বানানোর ক্ষমতা নেই। 

কবিতা যখন লিখছেন, কবিতাকে সংগ্রাম হিশেবেই নিতে হবে। অনেকে কবিতাকে ফ্যাশান হিশেবে নেয়; অলস অবসর কাটানোর জন্যে লেখে। কবিতা আমার কাছে সংগ্রাম। আমার রক্তের ভিতর কথা বলে। এটা খুবি সিরিয়াস বিষয়। খেলা অবশ্যই নয়, ভাবালুতাও নয়। কবিতা আমার কাছে পরম। পরম মানে নিত্য। পরমের কাছে আমি রক্তাক্ত হয়েই যাবো।

০৭.
বাহুল্য মানে হলো আপনার কবিতায় হাজার হাজার শব্দ, কিংবা পরপর চিত্রকল্প। মানে কমপ্যাক্ট না। এটা অবশ্য আপনার স্টাইলও হতে পারে। কিন্তু পাঠক হিশেবে আমার মনে হলো যতোটা না কবিতার ঘোর, তারচে' বেশি শব্দের ঘোর আপনার; শব্দের প্রতিও আপনার দারুণ মায়া। যদিও আপনার শব্দ এবং শব্দ জোড়গুলো অনেক সুন্দর। তথাপি পড়তে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলি, কোন জায়গায় রাখবো ধ্যান। এটা অনেকটা অদ্ভুতসুন্দর নকশার মতো: দৃষ্টি কেবল ঘুরতে থাকে উপরে, এটা ধাঁধা তৈরি করে। ভিতরে ঢুকে গেলে পাশাপাশি অনেক সুন্দরকে অবহেলা করে যেকোনো একটি সুন্দরের ভিতর ঢুকে পরিভ্রমণ করতে হয়। ফলে অন্যান্য সুন্দরের জন্যে হাহাকার জাগে প্রাণে।

আমি যেটা মানি, কবিতার পরিণতি শিল্পনন্দনে, নকশায় নয়। একটি কবিতা একটিমাত্র দরোজা; যে দরোজার ওপাশে অভাবনীয় সুন্দরতা প্রতীক্ষায় কম্পমান- পাঠক ঘোরলাগাসারল্যে প্রবেশ করবে এবং সৌন্দর্যের ভুবনকে উত্তরোত্তর সুন্দর করবে তার স্বপ্নসত্যকল্পনায়। এবং অবশ্যই প্রতিটি পাঠকই আলাদা স্রষ্টা। কবি কেবল এক অপার সৌন্দর্যের দুয়ারই তৈরি করে দেন। আর কিছু না। দরজার ওপারের জগত পাঠকের সৃষ্ট।

কবিতা আমার কাছে একইসাথে সুরা ও সুন্দর। সুরা পান করতে হয় ধীরে ধীরে তাহলে বমিও হয় না এবং অভাবনীয় ঘোর তৈরি হয়, সুন্দরের কাছেও তেমনি যেতে হয়।

০৮.
জীবনানন্দের কবিতা আমাকে শান্তি দেয়। ঘোর দেয়। হাহাকার দেয়। কিন্তু হাংরির কবিতা আমাকে আরো হাংরি করে দেয়। মন চায় আকাশ কামড়াই, বাতাস কামড়াই।

এলেনের দৃষ্টিভঙ্গি বৈশ্বিক ছিলো। কারণ তার জানাশোনার পরিধি ব্যাপক ছিলো। কিন্তু তিনিও কবিতা নিয়ে এক অর্থে স্টান্টবাজিই করেছেন। যেহেতু তিনি একটা সময় কবিতা লিখেছেন তাই নথিভূক্ততো অবশ্যই থাকবেন। কিন্তু ইয়েট্স, বোদলেয়ার, নের্ভাল, জীবনানন্দ, সিলভিয়া প্লা, এমিলি ডিকিনসনের মতো মানুষের বুকের ভিতর কি তার কবিতা লেখা থাকবে?

মলয়ের ক্ষমতা আছে সন্দেহ নাই। কিন্তু কবিতায় নানা নিরীক্ষা করতে গিয়ে তিনি কবিতার কী দশাটা যে করেছেন, পড়লেই বুঝতে পারবেন। আপনার জানার কথা তার প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতারকবিতাটির আমার ভালো লাগে। কেননা সেই কবিতার মধ্যে তিনি যে প্রচণ্ড গতির সঞ্চার করতে পেরেছিলেন- সেই গতি তার বাক্যস্থ শব্দ ছাপিয়ে অবয়ব নিয়ে তীব্রবেগে প্রবাহিত হয়েছে।

হাংরি-জেনারেশন হলো এলেনের বিট-জেনারেশনের অনুকরণ। শক্তি আর সুনীল বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তাই শক্তি সার্থক, ‘দুয়ার এটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া, কেবল শুনি রাতের কড়া নাড়া...।সুনীলেরও কিছু কবিতা খুবি ভালো,‘যমুনা আমার হাত ধরো স্বর্গে যাবো।সুনীল যদি কেবল কবিতাই লিখতেন, তাহলে অনেক ভালো কবি
হতেন। তিনি একই সাথে সবকিছু হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সবাই রবীন্দ্রনাথ হতে পারে না। জীবনানন্দও পারেন নি। তাই তার গল্প আর উপন্যাস কবিতার মতো সার্থক নয়। হাংরি- জেনারেশনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবি উপলকুমার বসু। আর মলয় এখন পোস্টমর্ডানিজমের প্রতিনিধি। কবিতা লেখেন গিন্সবার্গ, রন প্যাজেট ইহাদের অনুকরণে।

সার্থক শব্দজোড় হলে কবিতা সবকিছুই হজম করতে পারে, মূত্র থেকে মধু পর্যন্ত। যেসব ছন্দমূর্খ কবিতায় শব্দের প্রয়োগ জানে না, তাদের লেখা পড়তে গেলে কিছু শব্দ চোখা-পেরেকের মতো লাগে। তখন বাপান্ত করতে না পেরে ত্রাহি করা ছাড়া উপায় থাকে না। মানে ভিখ চাই না আম্মা, কুত্তা লইয়া যান এই অবস্থা।

আমি সবসময় মনে রাখি, প্রকৃত অর্থে যিনি কবিতার পাঠক তিনি কখনোই মাথামোটা গাভী নন।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন